ধুমপান, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ


ধুমপান বলতে তামাকজাত পণ্য বিশেষ পদ্ধতিতে পুড়িয়ে প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ ও নিঃশ্বাসের সাথে ছেড়ে দেয়াকে বুঝায়। ধুমপানের অনেক পদ্ধতির মধ্যে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে সহজলভ্য এবং প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে সিগারেটের মাধ্যমে ধুমপান। বর্তমান বিশ্বের সকল শ্রেণির বিপুল সংখ্যক লোক ধুমপানে অভ্যস্ত হলেও তরুণ সমাজের নিকট এখন এটি অনেকটাই ফ্যাশনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ শিক্ষার্থীরাও জেনে শুনে এ বিষ পান করে যাচ্ছে এবং পরিবেশে বিষ ছড়াচ্ছে। আজকের এ লেখায় ধুমপানের স্বাস্থ্যগত মারাত্মক ঝুঁকির পাশাপাশি এটি পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি সাধন করছে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তসারে আলোচনা করা হবে।

ধুমপান ও স্বাস্থ্যহানি

‘ধুমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’ এ কথাটি সবাই জানে। প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে একথাটি অথবা তার সমার্থক কথা উল্লেখ থাকে। কিন্তু এটা কতটা ক্ষতিকর- এ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের জ্ঞান অস্পষ্ট।

ধুমপান ও ক্যান্সার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটাচ্ছে যে রোগগুলি, তন্মধ্যে ক্যান্সার দ্বিতীয় এবং তামাক ব্যবহারই ক্যান্সারের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। সিগারেট ক্যান্সার সৃষ্টিকারী সম্ভাব্য (কারসিনোজেনিক) পদার্থ ধারণ করে যা ফুসফুস, খাদ্যনালী, গলা এবং স্বরতন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও এটি মূত্রথলি, অগ্নাশয়, ঠোঁট, কিডনী, জরায়ু ও ঘাঢ়ের ক্যান্সারের সাথে সংশ্লিষ্ট। ফুসফুস ক্যান্সার ছাড়াও ক্রোনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, এম্ফাইসেমা এবং ক্রোনিক ব্রংকাইটিস নামক আরো কিছু ভয়ংকর ফুসফুসের রোগ সৃষ্টিতে ধুমপান অবদান রাখে।

ধুমপান আরো যেসব রোগের কারণ

ধুমপান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং শরীরকে সংক্রামক ব্যাধির প্রতি দুর্বল করে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে হার্ট এটাক এবং স্ট্রোকের কারণে। ধুমপান রক্তনালি সঙ্কুচিত করে হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্ত প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে হার্ট এটাক ও স্ট্রোক ত্বরান্বিত করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও ধুমপানের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। এছাড়াও ধুমপান মানুষের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধুমপায়ীরা অধুমপায়ী থেকে কমপক্ষে ১০ বছর কম বাঁচে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতি বছর ৫০ লাখেরও অধিক মানুষ মারা যায় শুধু সিগারেটের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধুমপানের কারনে।

ধুমপান ও পরিবেশ দূষণ

ধুমপান শুধু স্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি নয়, এটি পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করেে। এটি বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষণ করে। এটি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বায়ু, মাটি ও পানি দূষণের সাথে সরাসরি জড়িত। এছাড়া এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ অরণ্যধ্বংসের সাথে সংশ্লিষ্ট।

ধুমপান ও বৃক্ষনিধন

সিগারেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো তামাক। আর বাস্তবতা হলো অধিকাংশ তামাক চাষ করা হয় রেইনফরেস্ট এলাকায়। সে এলাকার ঘন বনাঞ্চল সাফ করে তামাক চাষ করা হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি ৩০০টি সিগারেট প্রস্তুতির জন্য একটি বৃক্ষ ধ্বংস করা প্রয়োজন হয়। এছাড়া তামাক পাতা শুকানোর কাজেও কাঠ পোড়ানো হয়। এভাবে ধুমপান ব্যাপকভাবে বন উজাড়ের দিকে পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে যা বৈশ্বিক ঊষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ।

ধুমপান ও রাসায়নিক বর্জ্য

তামাক চাষ থেকে শুরু করে একে ধুমপানোপযগী করা পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থের প্রয়োজন হয়- যেগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ প্রক্রিয়ায় বহুল ব্যবহৃত একটি রাসায়নিক পদার্থ হচ্ছে এলডিকার্ব। এটি মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণী- সকলের জন্য মারাত্মক বিষাক্ত। এছাড়াও এটি খুব সহজে পানির মাধ্যমে মাটিতে চলে যেতে পারে এবং বহু বছর ধরে বিষ-ক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ১৯৯৫ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, প্রতি বছর ২৩০ কোটি কেজি বর্জ উৎপাদন হয় শুধু সিগারেট উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে-এছাড়াও ২০৯ কেজি উৎপাদন হয় শুধু রাসায়নিক বর্জ। বর্তমান সময়ের বর্জের পরিমাণ যে আরো ভয়াবহ সেটা সহজেই অনুমেয়।

ধুমপান যেভাবে বায়ু দূষণ করে

সিগারেটের উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ধুমপানে বিপুল পরিমাণ বায়ুদূষক উৎপাদিত হয়। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি ধাপ হলো কিউরিং। এই ধাপে কাঠ পোড়াতে হয় অথবা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াতে হয়-যা গ্রীন হাউজ গ্যাস এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস বায়ুমন্ডলে মুক্ত করে। প্রক্রিয়াজাতকৃত তামাক বা সিগারেট ভোক্তা বাজারে প্রেরণ প্রক্রিয়াতেও গ্রীন হাউজ গ্যাস উৎপাদন হয়। ধুমপানের সময় গ্রীন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস উৎপাদিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি বছর শুধু ধুমপানের ফলে প্রায় ২৬০ কোটি কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড এবং ৫২০ কোটি কেজি মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে অবমুক্ত হয়। এভাবে ধুমপান বায়ুদূষণে ভূমিকা পালন করে।

ধুমপান যেভাবে মাটি ও পানি দূষণ করে

ধুমপান ভূমিদূষণেও ভূমিকা রাখে। সিগারেট পান করার পর অবশেষ ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হয়- যা সাধারণত সেলুলোজ এসিটেটের দ্বারা গঠিত। এটি অতি বেগুনি রশ্মি দ্বারা বিয়োজিত হতে পারে, তবুও এর উপাদানগুলো মাটিতে দীর্ঘদিন থেকে যায়। গবেষকদের মতে, এটি মাটিতে প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে এবং মাটিকে দূষিত করে রাখে। এছাড়াও এ অবশেষ ঝড়-বৃষ্টি ও জলপথের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। যেমন- ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক সমুদ্রোপকুল পরিস্কার প্রোগ্রাম প্রায় ৩২ লাখ সিগারেটের অবশেষ পরিস্কার করে বিভিন্ন সমুদ্রসৈকত ও জলপথ থেকে- যা ছিল অন্যান্য বর্জের প্রায় দ্বিগুণ। এগুলো শুধু জলপথগুলোকেই দূষিত করে না, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে, এমনকি ভূ-গর্ভস্থ পানিও দূষিত করে।

ধুমপান ও দাবানল

ধুমপান দাবানলেরও অন্যতম কারণ। প্রতিবছর শুধু জ্বলন্ত সিগারেটের অবশেষ দ্বারা সংগঠিত দাবনলের পরিমাণ অগণিত। প্রতিবছর প্রায় ১৭০০০ লোক সারা বিশ্বজুড়ে পুড়ে মারা যায় সিগারেটের নিক্ষিপ্ত জ্বলন্ত অবশেষ বা সিগারেট লাইটার দ্বারা সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের কারণে এবং সম্পত্তির হিসেবে এর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ধরণের দাবানলের কারণে জীববৈচিত্র, জীবের আবাসস্থলের ক্ষতি, বায়ুদূষণ, অরণ্যবিনাশ, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতির মাধ্যমে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। উদাহরণস্বরুপ ১৯৮৭ সালে চীনে সংগঠিত হওয়া দাবনলের কথা বলা যায়। এ দাবানলের ফলে ৩০০ লোক মারা যায়, ৫০০০ জন হয় গৃহহীন এবং প্রায় ১৩ লক্ষ হেক্টর জমি ধ্বংস হয়ে যায়।


ধুমপান, বাংলাদেশ ও বিশ্ব

ধুমপানের এত স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশের প্রতি এত হুমকি থাকা সত্বেও ধুমপায়ীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সাথে সাথে বুঝা যায় না। বরং এটি ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করে যায়। বাংলাদেশে ধুমপানের অবস্থা দিন দিন আরো ভয়ানক হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুসারে ২০০৯ সালে ১৫ বছরের উপরের বয়সের জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাকজাত পণ্য গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৪৩%, যা ২০১৬ সালের দিকে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৪%। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। বিশেষকরে আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনেকে জেনেশুনে এ বিষ পান করে যাচ্ছে এবং অন্যদেরকেও উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশের ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) ৪(১) ধারা অনুসারে পাবলিক পরিবহন বা পাবলিক প্লেসে ধুমপান করলে ৩০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। কিন্তু এ আইনের কোন বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয়না। ফলে প্রায়শই দেখা যায় ট্রেনে, বাজারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে কিংবা অন্য যে কোন পাবলিক প্লেসে ধুমপান করছে শিক্ষিত(?), অর্ধ-শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত দেশের জনতারা। এভাবে তারা নিজের ক্ষতির পাশাপাশি পরোক্ষ ধুমপানের দ্বারা অন্যদেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে। এ বিষয়ের সমাধানকল্পে সরকারের পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসা উচিত। অপরকে ধুমপানে অনুৎসাহিত করার জন্য সভা, সেমিনার, প্রচারপত্র, লিফলেট, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সবকিছুর সহায়তা নেয়া উচিৎ। সরকারের উচিৎ ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করা। প্রয়োজনে আবার সংশোধন করা। এছাড়াও, ধুমপান যেহেতু পরিবেশ তথা এ পৃথিবীর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে, মহাবিশ্বের মনুষ্য ও অন্যান্য প্রাণের আবাসোপযগী একমাত্র গ্রহ এ সুন্দর পৃথিবীকে রক্ষায় আমাদের উচিৎ ধুমপানসহ পরিবেশ-বিধ্বংসী সবকিছু চিরস্থায়ীভাবে পরিত্যাগ করা। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী প্রজাতি হিসেবে এটা আমাদের প্রতি স্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত নৈতিক দায়িত্ব।
লেখকঃ
মো. মাসুম বিল্লাহ
শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

Popular posts from this blog

How to mention anyone in facebook post comment or message যেভাবে ফেসবুক পোস্ট কমেন্ট অথবা মেসেঞ্জারে কাউকে মেনশন করবেন

গীবত করা মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর লিরিক্স Gibot kora manush gulo shob cheye beshi voyongkor lyrics by saimum shilpigoshthi

Noakhali Science and Technology University(NSTU) BUS Schedule