মুক্তিযুদ্ধ ও লাকসাম
মুক্তিযুদ্ধঃ
আমাদের বাঙ্গালি জাতির সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয় অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ। এত আত্মদান, এত ত্যাগ কোথায়, কোন দেশ এমন গর্ব করে বলতে পারে যে, আমরা লাখ লাখ মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করেছি? আমাদের দমিয়ে রাখার কত চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এমন অভ্যুদয় নিয়ে তো গর্ব করবই।যে অভ্যুদয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ,একটি পরিচয়।আর এ দেশ এমনি এমনি আমাদের দিয়ে দেয়া হয়নি,তার জন্য দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে,হারাতে হয়েছে ৩০ লক্ষ মানুষের জিবন,লাঞ্চিতা হতে হয়েছে অগনিত নারীকে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলেই সবার আগে বলতে হবে বঙ্গবন্ধুর কথা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনই জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্ভুদ্ধ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সেই অসাধারণ ভাষনই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ডাক।“রক্ত যখন দিয়েছি,রক্ত আরো দিবো,তবুও এদেশের মানুষকে স্বাধীন করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ।এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তার এই কালজয়ী আহবানই মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করাছিলো।যার ফলশ্রুতিতে ২৫ মার্চ রাতে হানাদারদের হামলার পরপরই সারাদেশব্যাপী জাতির সুর্য্সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধে ঝাপিয়ে পড়ে।আর এই দীর্ঘ ৯মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশগ্রহনে স্বতঃস্ফুর্ত ছিলো দেশের সর্বস্তরের মানুষ-কৃষক,শ্রমিক,দিনমজুর,।আমাদের কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাও তার ব্যাতিক্রম না।আমাদের লাকসামবাসিদের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার গৌরবোজ্জল ইতিহাস।আজো আমাদের লাকসাম জংশন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে।আমি যে গ্রামটাতে বাস করি সেটার নাম পাইকপাড়া,আর এটা লাকসাম জংশনের পুর্ব পাশের গ্রামই। আমাদের অত্র এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিচে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করছি।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লাকসাম
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় মুক্তুযুদ্বের সময় আমাদের কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাও ১১টি সেক্টরের একটি গুরুত্বপুর্ণ সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে লাকসাম জংশনও দৌলতগঞ্জ বাজার দখলে নিয়ে লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরিতে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। আর এখান থেকেই চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা নিয়ন্ত্রণ করতো। এ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা, অস্ত্র এবং যুদ্ধের যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ করা হতো এখান থেকেই। যুদ্ধকালীন পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে লাকসাম জংশন এলাকায় ৪টি সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার আবদুল জলিল, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ব্রিগেডিয়ার দিদারুল আলম, মেজর এনাম আহমেদ এবং ফ্লাইট সার্জন ছিদ্দিকুর রহমান।পরবর্তীতে মিত্র বাহিনী লাকসাম জংশন ও সিগারেট ফ্যাক্টরীসহ বিভিন্ন অবস্থানের উপর বিমান হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। দুই দিন ধরে প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাক বাহিনী লাকসাম থেকে পশ্চিম দিকে মুদাফরগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালাতে থাকে।পালানোর সময় মিত্র বাহিনী চুনাতী নামক গ্রামে এবং মুক্তিবাহিনী শ্রীয়াং ও বাংলাদেশে পাক বাহিনীকে মুখোমুখি আক্রমন করেন। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর অসংখ্য প্রাণহানিসহ অনেক পাকসেনা বন্দি হয়। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিবাহিনী লাকসামকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন।
হানাদারদের পাষণ্ডতার সাক্ষী আমাদের লাকসামঃ
পাকিস্তানী নরপিশাচ হানাদারদের পাষন্ডতা ও নির্মমতার সাক্ষী হয়ে রয়েছে আজো আমাদের লাকসাম।তথ্য সংগ্রহে জানতে পারি যে,আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসহায় নারী-পুরুষ,আবাল,বৃদ্ধা,বনিতাদের ধরে এনে লাকসামের ঘাটিতে শাস্তি দেয়া হত,আর নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে নিরীহদের হত্যা করে তারা লাকসাম জংশনের রেললাইনের পুর্বপাশের বেলতলী নামক একজায়গায় তাদের কবর দিয়ে রাখতো,যা আজো “বেলতলীর বধ্যভুমী”নামে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এ ঘাঁটিতে বিভিন্ন স্থান হতে বাঙালি নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন শেষে হত্যা করে পাশেই বেলতলী নামক স্থানে মাটি চাপা দেয়া হতো। বর্তমানে এ স্থানটি ‘বেলতলি বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত।পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ এই বধ্যভূমিটি লাকসাম রেলওয়ে জংশনের কাছে ইতিহাস হয়ে রয়েছে। স্টেশন ভবন থেকে সামান্য দক্ষিণে কেবিন বরাবর রাস্তার পূর্বপাড়ে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাকা ব্যাংকারটি রয়েছে, তার উত্তর ও দক্ষিণে বিশাল জায়গা নিয়ে তার অবস্থান। বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা ও বর্তমান ফেনী জেলার অনেক কেই এখানে জীবন দিতে হয়েছে। কতজন এখানে শুয়ে আছেন তার সঠিক হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়।কত নাম না জানা অসহায় মানবত্মার কন্ঠরোধ করে এখানে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে,তার কোন হদিস নেই।উক্ত বেলতলী গ্রামটি আমাদের পাইকপাড়া গ্রামের উত্তর পাশে অবস্থিত।আমরা অথবা এলাকার লোকের কিছুদিন পুর্বেও জানতোনা যে,এখানে কতবড় ইতিহাস লুক্কায়িত আছে,শুধু প্রচারণা ও সংরক্ষণের অভাবে।তাই,মুক্তিযুদ্ধের এসব স্থানসম্পর্কে আরো অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত।তবেই তরুন প্রজন্ম ইতিহাস সচেতন হবে।এ জায়গাটার গনহত্যা আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি।
বেলতলীর বধ্যভুমি
লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পশ্চিম পাশেই নশরতপুর গ্রাম। এখানে যুবতীদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। নিয়ে যাওয়া হতো বধ্যভূমিতে। পশ্চিমগাঁওয়ে অনেক রাজাকার ছিল।বকর আলী রাজাকার অন্যতম। বকর আলী কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে, কিভাবে সে পাকিস্তানী সৈন্যদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বাঙ্গালী মহিলাদের ধরে এনেছে, সবই এলাকার প্রবীণদের মুখে মুখে এখনো প্রচারিত হয়ে আসছে। নশরতপুরের শফিক রাজাকারের কুকীর্তি এখনো মানুষের মুখে মুখে। রাজাকার মফিজ তো জনগণের হাতেই টুকরো টুকরো মাংসে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে এমন অনেক রাজাকার-আলবদরই এখন তাদের অতীতের কুকীর্তির চিহ্ন মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। যারা জানেন,অজস্রস্মৃতির ভিড়ে তাদের কাছেও বহুদিন আগের কোনো ঘটনা হয়ে আজও মাঝেমধ্যে সেই দিন নাড়াদিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, স্বজনহারানোর ব্যথা আজও প্রিয়জনকে কাঁদায়।লাকসামের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের নামঃ
পুর্ববর্তী পরিচ্ছেদে দিয়েছিলাম কিছু রাজাকারদের কু-কীর্তির কথা,তারা আমাদের লাকসামের কলঙ্ক।তবে আমাদের লাকসামের গর্ব আছে,লাকসামে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আছে,যারা নিজের জীবন বাজি রেখে এ দেশকে স্বাধীন করেছিলো।আমাদের গ্রাম পাইকপাড়া ও পার্শ্ববর্তী আরো কয়েকটি গ্রামের বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন।তাদের কতেকেরনাম তুলে ধরা হলোঃ-- আবুল হোসেন ননী(বড়তুপা)
- আবদুর রহিম(ডুরিয়া বিষ্ণপুর)
- আজিজুল করিম (হুমায়ন)(পাইকপাড়া)
- জাহাঙ্গীর মাওলা চৌধুরী(মিশ্রী)
- মোঃ মোশারফ হোসেন(কান্দিরপাড়)
- মোঃ মোখলেছুর রহমান(পাইকপাড়া)
- আবদুল বারী মজুমদার যুদ্ধাঃ(পাইকপাড়া)
- আনা মিয়া(পাইকপাড়া)
- আবুল খায়ের(পাইকপাড়া)
- মোঃ আব্দুল মান্নান(পাইকপাড়া)
Comments
Post a Comment