কোরআন ও হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে ধূমপান হারাম ও তার প্রমাণ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
আসসালামু আলাইকুম।
মদ খাওয়া হারাম এটা সকলে মানলেও সিগারেট বা ধূমপান করা হারাম এটা অনেকেই
মানতে চান না। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝাতে চান যে এটা হারাম নয়, বরং মাকরুহ। আসুন আমরা
আজকে জানার চেষ্টা করব কেন ইসলামের দৃষ্টিতে সিগারেট খাওয়া হারাম।
সিগারেট বা ধূমপান কী হালাল নাকি হারাম
ইসলামে কোন বিষয় হারাম হওয়ার জন্য কোরআন বা সহীহ হাদিসের একটি দলিলই যথেষ্ট।
কিন্তু সিগারেট বা ধূমপান যে হারাম এ বিষয়ে আমরা একাধিক দলীল দেখাব ইনশাআল্লাহ। সিগারেট
হারাম এর কারণঃ
- এটিতে আছে দুর্গন্ধ
- ব্যক্তির নিজের জীবনের জন্য ক্ষতিকর
- আশেপাশের অন্য ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিকর
- এটি অপব্যয়
- রোগ ব্যাধির কারণ
- মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অপছন্দের কারণ। সল্লেল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম
- সামাজিক মর্যাদা নষ্টের কারণ
সিগারেট বা ধূমপান হারাম হওয়ার দলীল
এবার দেখি এই কারণগুলো সম্পর্কে ইসলাম কী বলেঃ
১। দুর্গন্ধ
ধুমপায়ীদের মুখে তীব্র দুর্গন্ধ থাকে যা আশেপাশের মানুষদের অত্যন্ত কষ্ট
দেয়। যারা অধুমপায়ী তারা ধুমপায়ীদের ধুমপানের গন্ধে বিরক্ত হয়।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন,
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِي جَارَهُ.
“যে আল্লাহ তাআলা ও শেষ দিবসের ওপর ইমান রাখে সে যেন তার আশপাশের মানুষদের
কষ্ট না দেয়”(১)
মুসলমানকে কষ্ট দিতে মহান আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوْا فَقَدِ احْتَمَلُوْا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِيْنً
‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা
মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে’ (২)।
মুমিনকে কষ্ট দিতে নিষেধ করে রাসূল (সঃ) বলেন,
يَا مَعْشَرَ مَنْ قَدْ أَسْلَمَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يُفْضِ الإِيْمَانُ إِلَى قَلْبِهِ لاَ تُؤْذُوْا الْمُسْلِمِينَ
وَلاَ تُعَيِّرُوهُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ تَتَبَّعَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ وَلَوْ فِى جَوْفِ رَحْلِهِ
‘হে ঐ জামা‘আত! যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছ, কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান
মযবূত হয়নি। তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিবে না, তাদের লজ্জা দিবে না এবং তাদের গোপন
দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না।‘(৩)
২। ধূমপান জীবন বিধ্বংসী ও
মরণব্যাধির কারণ
ধূমপান নিজের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় যেসব রোগে তার মধ্যে দ্বিতীয় হচ্ছে ক্যান্সার।
আর ক্যানসারের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ
মারা যায় (৪)। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি)’র মতে,
ফুসফুস ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণকারী প্রতি ১০জনের ৯জনই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
ধুমপানের ভুক্তভোগী (৫)। অপরদিকে, যুক্তরাজ্যের ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের মতে, ধূমপান
কেবল ফুসফুস ক্যান্সারই নয় এটি বরং আরো ১৫ ধরণের ক্যান্সারের জন্য দায়ী (৬)। সিগারেটের
প্যকেটের গায়েই লেখা থাকে ধূমপান মৃত্যু ঘটায়। মহান আল্লাহ পাক বলেন,
“وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَكُمۡ”
অর্থাৎ, “তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করোনা”।
যারা এটা করবে তাদের শাস্তির ব্যাপারে পরের আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,
وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِكَ عُدۡوَانًا وَّ ظُلۡمًا فَسَوۡفَ نُصۡلِیۡهِ نَارًا ؕ وَ كَانَ ذٰلِكَ عَلَی اللّٰهِ یَسِیۡرًا
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন ক’রে
অন্যায়ভাবে এটা করবে, তাকে আমি অতিসত্বর অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।
(৭)।
মহান আল্লাহ পাক অন্যত্র বলছেন,
وَلا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ
তোমরা নিজের হাতে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। (৮)
৩। ধূমপান আশপাশের
ব্যক্তির জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর
ধুমপায়ীদের ধুমপানের সময় যারা আশেপাশে থাকে তারাও
মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, আমাদের
দেশে কর্মক্ষেত্রে ৬৮ শতাংশ পুরুষ, ৩০ শতাংশ নারী এবং পাবলিক পরিবহনে ৬৯ শতাংশ
পুরুষ, ২১ শতাংশ নারী পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন (৯)। বাংলাদেশে পুরুষদের তুলনায়
নারী ও শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে মানুষ ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগ
ও স্ট্রোক, বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মদান, শিশুদের কানের ইনফেকশন, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস
ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
কিন্তু
ইসলামে যৌক্তিক কারণ ব্যতীত কারো ক্ষতি করা হারাম। নবীজি (সঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি
অন্যের ক্ষতি করবে, আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দিবে
আল্লাহ তাকে কষ্ট দিবেন’ (১০)। রাসূলুল্লাহ
(সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের ক্ষতিসাধন করে বা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
করে সে অভিশপ্ত’(১১)। এছাড়াও তিনি বলেছেন, কেউ অন্যের ক্ষতি করলে আল্লাহ
তার ক্ষতিসাধন করবেন। কেউ অযৌক্তিকভাবে কারো বিরোধিতা করলে আল্লাহ তার বিরোধী হবেন
(১২)।
অন্য ব্যক্তির ক্ষতির দরুণ এটি বান্দার হক নষ্ট
করার মত পাপ যা আল্লাহ তায়ালা সাধারণত ক্ষমা করেন না যতক্ষণ না ঐ বান্দা মাফ করে
দেয়। এটি একজন জান্নাতপ্রত্যাশী মুমিন বান্দার জন্য মহা আতঙ্কের কারণ। কেননা রাসুলুল্লাহ
(সা.) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে ওই ব্যক্তি হচ্ছে দেউলিয়া যে কিয়ামত দিবসে নামাজ,
রোজা, জাকাতসহ বহু আমল নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সঙ্গে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে
মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত (হত্যা)
করেছে, কাউকে মারধর করেছে ইত্যাদি অপরাধও নিয়ে আসবে। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল
হতে এ ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে, ও ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ বদলা
(বিনিময়) নেওয়ার আগেই তার সৎ আমল নিঃশেষ হয়ে গেলে তাদের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে
দেওয়া হবে, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (১৩)।
৪। ধূমপান অপব্যয়
ধূমপান সুস্পষ্ট অপব্যয়। সিগারেটের মূল্য সরকার
প্রতি বছর বৃদ্ধি করে। তারপরও ধূমপায়ীরা চড়া মূল্যে সিগারেট কিনে খায়। সিগারেটের
ন্যূনতম শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা স্বাস্থ্যগত উপকার না থাকলেও ক্ষতি আছে শতভাগ।
তাই সিগারেটের পেছনে ব্যয় করা পুরো অর্থই অপব্যয়। আর অপব্যয় করা হারাম। পবিত্র
কোরআনে অপব্যয়কারীকে অভিশপ্ত শয়তানের ভাইয়ের সাথে তুলনা করা হয়েছেঃ
وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا، إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ
‘তুমি অপব্যয় করবে না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের
ভাই’ (১৪)
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, ধূমপান তথা সিগারেট, বিড়ি,
জর্দা ইত্যাদি খাওয়া হারাম। তাই আমাদের এই জঘন্য বদভ্যাস থেকে অতিসত্বর ফিরে এসে
তওবা করা বাঞ্ছনীয়।
বর্তমান সময়ের যেসকল আলেমগণ ধূমপান কে হারাম বলেছেনঃ
১. ইউসুফ আল কারদাওয়ি (রহ.)
২. মিজানুর রহমান আজহারি (হাফি.)
৩. সাইফুল্লাহ মাদানি (হাফি.)
৪. আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ (হাফি.)
৫. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৬. মতিউর রহমান মাদানি (হাফি.)
৭. আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া (হাফি.)
৮. জাকির নায়েক (হাফি.)
৯. মুফতি মেঙ্ক (হাফি.)
১০. আসিম আল হাকিম (হাফি.)
১১. হাবিবুর রশিদ (হাফি.)
১২. কামরুল ইসলাম সাইদ আনসারি (হাফি.)
১৩. মঞ্জুর ইলাহি মাদানি (হাফি.)
১৪. মুস্তাফিজ রাহমানি (হাফি.)
১৫. মোখতার আহমেদ (হাফি.)
এছাড়াও আরও অগণিত আলেম ধূমপানকে সরাসরি হারাম বলেছেন। আসুন আমরা এই অভিশপ্ত
হারাম অভ্যাস থেকে নিজে বাঁচি অন্যকেও বাঁচাই। আল্লাহ সহায় হোন। আমিন।
তথ্যসূত্রঃ
১. বুখারী, হাদিস নং- ৪৮৯০; মুসলিম, হাদিস নং- ১৮৩
২. আহযাব আয়াত ৫৮
৩. তিরমিযী হাদিস নং- ২০৩২; হাদিস নং- ৫০৪৪
৪. https://seer.cancer.gov/statfacts/html/common.html
৭. সুরা নিসা আয়াত ২৯-৩০
৮. সুরা বাকারা
আয়াত ১৯৫
১০. তিরমিযী হাদিস নং- ১৯৪০, আবূ দাউদ হাদিস নং- ৩৬৩৫, আহমাদ হাদিস নং- ১৫৩২৮, ইরওয়া হাদিস নং- ৮৯৬
১১. সুনানে তিরমিজি হাদিস নং- ১৯৪১
১২. আবু দাউদ হাদিস নং- ৩৬৩৫
১৩. তিরমিজি হাদিস নং- ২৪১৮
১৪. বনী ইসরাঈল আয়াত ২৬-২৭
সংকলনেঃ মোঃ মাসুম বিল্লাহ
ফাজিল (বিএ), ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
বিএসসি (অনার্স), এম এস, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
Comments
Post a Comment